রাজনীতি
ছাত্রদলের ১১ ইউনিটের কমিটি: ধর্ষক হত্যাকারীরা গুরুত্বপূর্ণ পদে

সেখানে বিগত দিনে রাজপথের ত্যাগী আর পরিশ্রমি নেতাদের বাদ দিয়ে 'মাই ম্যান' আর বিতর্কিতদের স্থান দেওয়া হয়েছে। এমনকি কমিটিতে বিবাহিতদেরই বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ নেতাকর্মীদের। যেটা সংগঠনের নীতিবহির্ভূত। আর এরকম ঘটনার পর থেকেই রাজধানী জুড়ে পদবঞ্চিতরা বিক্ষোভ মিছিল করছেন। তারা নতুন কমিটিকে অবাঞ্চিত ঘোষণা করে কলেজ ক্যাম্পাসে প্রতিবাদ করছেন।
অনুমোদিত ছাত্রদলের ১১ ইউনিটের আংশিক কমিটিকে আগামী ৪৫ দিনের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ করে কেন্দ্রীয় দপ্তরে জমা দিতে বলা হয়েছে। ছাত্রদলের দপ্তর সম্পাদক (সহসভাপতি পদমর্যাদা) জাহাঙ্গীর আলমের স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ছাত্রদলের সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব ও সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন নাছির এই কমিটি অনুমোদন করেন। ইউনিটগুলো হলো- জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা কলেজ, সরকারি তিতুমীর কলেজ, তেজগাঁও কলেজ, সরকারি বাঙলা কলেজ, সরকারি কবি নজরুল কলেজ, ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ, ঢাকা মহানগর উত্তর, ঢাকা মহানগর পূর্ব এবং ঢাকা মহানগর পশ্চিম শাখা।
নেতাকর্মীরা জানান, ঘোষিত এই কমিটিতে গত বছরের ২৮ আক্টোবর বিএনপির এক দফা আন্দোলন কিংবা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে সক্রিয় নেতাদের বাদ দেওয়া হয়েছে। যারা জেল-জুলুমের শিকার হয়েছেন তাদেরকে কমিটির কোথাও রাখা হয়নি। আবার গুরুত্বপূর্ণ মহানগর কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে মহানগর বিএনপির নেতাদের কোন পরামর্শও নেওয়া হয়নি। চিরাচরিত রেওয়াজ ভেংগে এভাবে কমিটি গঠন করায় ক্ষুব্ধ ও বিব্রত দুই মহানগর বিএনপি নেতারা। কিভাবে ও কোন প্রক্রিয়ায় এরকম কমিটি গঠন করা হয়েছে তাও কেউ বলতে পারেন না বলে জানান নেতাকর্মীরা।
তারা আরো জানান, ৫ আগস্টের পর চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িতরা, ধর্ষণ মামলার আসামি, অছাত্র এবং বিতর্কিত নেতাদের কমিটিতে পদায়ন করা হয়েছে। পক্ষান্তরে বিগত দিনে রাজপথে সক্রিয় থাকা নেতা-কর্মী, ২৮ অক্টোবরের পর থেকে আন্দোলন এবং বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে জোরালো ভূমিকা পালনকারী, হামলা-মামলায় জর্জরিত এবং স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের আমলে গুমের শিকার নেতাদের বাদ দেওয়া হয়েছে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদল নেতাকর্মীরা জানান, দীর্ঘদিন পরে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের আহ্বায়ক কমিটি হয়েছে। নতুন কমিটিতে আহ্বায়ক হলেন- মেহেদী হাসান হিমেল, সদস্য সচিব সামসুল আরেফিন। এই কমিটিতে বিগত দিনে যারা আন্দোলন সংগ্রামে জীবন বাজি রেখে আওয়ামী ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে রাজপথে থেকেছে তাদের বাদ দিয়ে নিজস্ব মাই ম্যান সেটআপ করতে সিন্ডিকেট করে পকেট কমিটি গঠন করেছে। পুরো ভাগাভাগির কমিটি হয়েছে। আর এ প্রক্রিয়ার সাথে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবদলের বিতর্কিত সদস্য সচিব রবিউল ইসলাম নয়নের প্রভাব রয়েছে। তার ইশারাতে বিএনপির কেন্দ্রীয় ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক রাকিবুল ইসলাম বকুল আর ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক নাছিরউদ্দিন নাছির এরকম কমিটি গঠনে ভূমিকা রেখেছেন। এই তিনজন একটি সিন্ডিকেট বলেও তারা জানান। এখানে নয়নের অনুসারী হিসেবে পরিচিত সামসুল আরেফিন বিগত আন্দোলনে তেমন ভূমিকা না থাকলেও গুরুত্বপূর্ণ পদে আনা হয়েছে। এছাড়া কমিটির অন্যান্য ২৮ যুগ্ম আহ্বায়ক ও সদস্যের মধ্যে বেশিরভাগই অপরিচিত এবং কম সক্রিয় বলে জানান নেতাকর্মীরা।
তেজগাঁও কলেজ শাখার ৩২ সদস্যবিশিষ্ট কমিটিতে আহ্বায়ক পদ পেয়েছেন তরুণ মোর্শেদ, সদস্যসচিব সেলিম হোসেন। তরুণ মোর্শেদ ২০১৩ সালের পর থেকে আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন না। তার বিরুদ্ধে ফার্মগেটের সেজান পয়েন্ট মার্কেটে চাঁদাবাজির অভিযোগ রয়েছে। সেলিম হোসেনও আন্দোলনের মাঠে নিয়মিত ছিলেন না। অথচ তেজগাঁও ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মো. বেলাল হোসেন খান গুমসহ ১৮ মাস কারাগারে ছিলেন, আন্দোলন করতে গিয়ে মিথ্যা হত্যা মামলাসহ একাধিক মামলার আসামি। অথচ তাকে কোনো পদে রাখা হয়নি। ছাত্রদল নেতা এইচএসসি পরীক্ষার্থী আশিকুর রহমানকে গত বছরের ২৮ অক্টোবরের পর অবরোধের মিছিল থেকে গ্রেপ্তার করা হলেও কমিটিতে তার স্থান হয়নি। এ ছাড়া সক্রিয় থাকা সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শামীম আহমেদ রবিন, নাঈমুল ইসলাম নাজিম, মামুন মালতিয়া, নাজমুল হুদা রাকিব, মেশকাত হোসেন, নাহিদুল ইসলাম ব্যাপারী, আনোয়ার হোসেন রানা কাউকে রাখা হয়নি। তেজগাঁও কলেজ কমিটি বাতিলের দাবিতে ধারাবাহিক বিক্ষোভ মিছিল করছেন হামলা-মামলায় নির্যাতিত নেতা-কর্মীরা।
ছাত্রদলের শীর্ষ দুই নেতার উদ্দেশে কলেজ ছাত্রদল নেতাকর্মীরা জানান, আর কী করলে ত্যাগী হওয়া যায়? যারা ২৮ অক্টোবর থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত আন্ডারগ্রাউন্ডে ছিল তারাই কী ত্যাগী? যারা রাজপথে জীবনবাজি রেখেছেন আন্দোলন করেছেন, কারাগারে গেছেন, গুমের শিকার হয়েছেন, রিমান্ডের নামে অকথ্য নির্যাতন সহ্য করেছেন তাদের স্থান কোথায় ?
সরকারি বাংলা কলেজের আহ্বায়ক মো. মোখলেসুর রহমান ও সদস্যসচিব ফয়সাল রেজার বিরুদ্ধেও রয়েছে বিস্তার অভিযোগ। আহ্বায়ক সরকারি বাংলা কলেজের ছাত্র নন, তিনি বাংলা কলেজের প্রাইভেট ছাত্র। সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক হাফিজুর রহমান হাফিজ বাংলা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করলেও এখন অনার্সের নিয়মিত ছাত্র নন। আর ফয়সাল রেজা একাধিক নারী নির্যাতন ও ধর্ষণ মামলার আসামি। তার বিরুদ্ধে ভুক্তভোগী এক নারী ছাত্রদলের সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব ও সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দিন নাছিরসহ কেন্দ্রীয় দপ্তরে অভিযোগ দিলেও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। কলেজের সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক সরদার মোহাম্মদ মিলন আন্দোলনের সর্বাগ্রে থাকলেও তাকে কমিটির কোথাও রাখা হয়নি। সহ সভাপতি তরিকুল ইসলাম তারেক সহ সভাপতি মেহেদী হাসান সহ সভাপতি বাপ্পি দেওয়ান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রাজু হাওলাদার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রাজনসহ অনেক নেতা কমী যারা আন্দোলনে মাঠে ছিলো তাদের কোথাও রাখেনি।
যদিও ফয়সাল দাবি করেন, তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ ভিত্তিহীন। যেকোনো ব্যক্তি অভিযোগ করতে পারেন কিন্তু প্রমাণ করার মতো পর্যাপ্ত তথ্য প্রমাণ নেই। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কেউ কেউ তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করছে।
ঢাকা মহানগর উত্তর শাখা ছাত্রদলের সভাপতি সালাউদ্দিন আহমেদ ও সাধারণ সম্পাদক মাহফুজুর রহমান লিপকনের চেয়েও যোগ্য নেতা ছিলেন। দুজনই রবিউল ইসলাম নয়ন ও ছাত্রদলের সভাপতি লোক। কিন্তু এখানে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে গুরুতর আহত মনিরুল ইসলামকে পদবঞ্চিত করা হয়েছে। তার মাথায় এখনো ২৩টি সেলাই রয়েছে। আর সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান মিম আন্দোলনে তেমন একটা সক্রিয় ছিল না। অপরদিকে মহানগর দক্ষিণের সাবেক সদস্যসচিব নিয়াজ মাহমুদ লিয়ন আন্দোলনে সক্রিয় থাকলেও কমিটিতে তার ঠাঁই হয়নি। এ ছাড়াও সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক কামরুল ইসলাম তপু, রুবেল আহমেদ সক্রিয় থাকলেও পদ পাননি। অথচ আন্দোলনে মহানগর পূর্ব শাখা ছাত্রদলের সিনিয়র সভাপতি আবদুল্লাহ জামান চৌধুরী আদিত্য এবার সভাপতি পদপ্রত্যাশী ছিলেন। তিনি বর্তমান সভাপতি সোহাগ ভূঁইয়ার চেয়েও যোগ্য নেতা।
মহানগর দক্ষিণ ছাত্রদলের নতুন কমিটিতে সিনিয়র সহ-সভাপতি মাহমুদ উল্লাহ মাহমুদ দুই কন্যার জনক। তার আপন ভাই কামরাঙ্গীরচর থানা ছাত্রলীগের নেতা। সহ-সভাপতি রুবেল আহমেদ রানার একাডেমিক কোন সার্টিফিকেট নাই। সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহিম ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে ৫ আগষ্ট পরবর্তি রাজধানীর কাপ্তান বাজারে চাদার দাবিতে এক হকারকে হত্যার এক নাম্বার আসামি। সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম রফিক উন্মুক্ত থেকে ২০১৮ সালে এসএসসি পাস করেছে
ইমাম হোসেনকে আহ্বায়ক ও সেলিম রেজাকে সদস্যসচিব করে তিতুমীর কলেজ শাখা ছাত্রদলের ৩৯ সদস্যের কমিটি দেওয়া হয়েছে। সেলিম রেজা বিবাহিত ও তার বাচ্চা রয়েছে। অথচ বিগত আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ ও পুলিশের হামলার শিকার যুগ্ম আহ্বায়ক মো. রিমু হোসেনের নাম অনেক নিচে রাখা হয়েছে। ২৮ অক্টোবরের আন্দোলনে সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হয় এই সাংগঠনিক ইউনিট। সেখানে যেসব নেতাকর্মীকে গ্রেফতারের পর দিনের পর দিন নিখোজ রাখা হয়, অকথ্য নির্যাতনের পর কারাগারে পাঠানো হয় এমন নেতাদের স্থান হয়নি।
ঢাকা কলেজ শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক হলেন পিয়াল হাসান, সদস্যসচিব মো. মিল্লাত হোসেন। পিয়াল হাসান আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন না। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সায়েন্সল্যাব মোড়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা বোরহান উদ্দিন ইশরাক ও তানভীর আহমদ মাদবরকে করা হয়েছে যুগ্ম আহ্বায়ক। বংশালে পুলিশের পা ভেঙে দিলেও মো. সাজ্জাদ হোসেন জেমিনকে সদস্য করা হয়েছে।
ঢাকা কলেজ ছাত্রদলের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক তারেক জামিল বলেন, এক মাস আগে ছাত্রদলের সেক্রেটারি নাসির উদ্দীন নাসিরের এলাকার সুবর্ণচর উপজেলা ছাত্রলীগের সদস্য সচিব ইয়াসিন আরাফাতকে সায়েন্সল্যাব থেকে ধরে পুলিশে সোপর্দ করেছিলাম। পরে সে নিজে থানা থেকে তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে যায়। সেই ক্ষোভের কারণে আমাকে ও আমার সহযোদ্ধাদের কমিটি থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। ঢাকা কলেজের ৩৬ সদস্য বিশিষ্ট যে যে কমিটি অনুমোদন করা হয়েছে সেখানে ৩/৪ জন ছাত্রলীগ আছে।
পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট শাখা কমিটিতে সভাপতি করা হয়েছে সাব্বির আহমেদকে। তার বিরুদ্ধে বিগত দিনে ছাত্রলীগ সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে। বিগত কমিটিতে সে সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। এ বিষয়ে তার বিরুদ্ধে কমিটির অন্যান্য ১৬ জন লিখিত অভিযোগ দিলেও সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিবের প্রশ্রয়ে তাকে রেহাই দেওয়া হয়। এবার তাকে ইউনিটের সভাপতি করা হয়েছে। ৫ আগষ্ট গণঅভ্যুত্থানের পর এই সাব্বিরের নেতৃত্বে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা ছাত্রদলের ব্যানারে কর্মসূচিতে ফিরছে বলেও একাধিক অভিযোগ রয়েছে।
এরকমভাবে প্রতিটি ইউনিট কমিটিতে বিতর্কিত আর অযোগ্যদের প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। নিজ নিজ বলয়ের নেতাদের প্রাধান্য দিতে গিয়ে বাদ দেওয়া হয়েছে ত্যাগী, নির্যাতিত আর রাজপথের কর্মীদের।
যদিও এসব অভিযোগ অস্বীকার করে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব বলেন, ‘আমরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেই যারা বিগত আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন তাদের দিয়ে কমিটি গঠন করেছি। নতুনদের কমিটিতে মূল্যায়নের চেষ্টা করেছি। এবারের কমিটি ৪৫ দিনের জন্য দেওয়া হয়েছে। এরপর প্রতিটি ইউনিটে সম্মেলনে ভোটের মাধ্যমে চূড়ান্ত নেতৃত্ব নির্বাচন করা হবে।’
জেআই