রাজনীতি
ই-অরেঞ্জের সোহেলকে এক বছরেও ভারত থেকে ফেরানো যায়নি
গ্রাহকদের হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে গত বছরের মাঝামাঝি আলোচনায় আসে দেশীয় ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ই-অরেঞ্জ। প্রতিষ্ঠানটির অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন বনানী থানার সাময়িক বরখাস্ত পরিদর্শক (তদন্ত) সোহেল রানা। তার বিরুদ্ধে গ্রাহকের প্রায় সাড়ে ২৮ কোটি টাকা আত্মসাতের প্রমাণ পায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সংস্থাটির অনুসন্ধানে উঠে আসে, নিজের পদ-পদবি গোপন করে ই-অরেঞ্জ নামের এমএলএম কোম্পানি খুলে সাধারণ গ্রাহকদের বিপুল অর্থ নিজের এবং ঘনিষ্ঠজনদের নামে পরিচালিত ছয়টি ব্যাংকের ৩১টি হিসাবে জমা করে পরে তা আত্মসাৎ করেন সোহেল রানা।
গ্রাহকদের হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে গত বছরের মাঝামাঝি আলোচনায় আসে দেশীয় ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ই-অরেঞ্জ। প্রতিষ্ঠানটির অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন বনানী থানার সাময়িক বরখাস্ত পরিদর্শক (তদন্ত) সোহেল রানা। তার বিরুদ্ধে গ্রাহকের প্রায় সাড়ে ২৮ কোটি টাকা আত্মসাতের প্রমাণ পায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সংস্থাটির অনুসন্ধানে উঠে আসে, নিজের পদ-পদবি গোপন করে ই-অরেঞ্জ নামের এমএলএম কোম্পানি খুলে সাধারণ গ্রাহকদের বিপুল অর্থ নিজের এবং ঘনিষ্ঠজনদের নামে পরিচালিত ছয়টি ব্যাংকের ৩১টি হিসাবে জমা করে পরে তা আত্মসাৎ করেন সোহেল রানা।
এরপরই পুলিশের এ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলার অনুমোদন দেয় দুদক। অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা সংস্থাটির উপ-পরিচালক মো. মোনায়েম হোসেন অভিযোগ অনুসন্ধান শেষে জানিয়েছিলেন, বনানী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সোহেল রানা এমএলএম কোম্পানি খুলে প্রতারণার মাধ্যমে সাধারণ গ্রাহকদের কাছ থেকে অধিক লোভের প্রলোভন দেখিয়ে তার নিজ নামে ও সংশ্লিষ্টদের নামে পরিচালিত ছয়টি ব্যাংকের ৩১ হিসাবে ২৮ কোটি ৪৯ লাখ ৩৭ হাজার ৬৫০ টাকা ৪০ পয়সা জমা করেন।
পরে সেখান থেকে ২৮ কোটি ৪৬ লাখ ৭২ হাজার ৯১৩ টাকা ৮০ পয়সা উত্তোলন করেন, যা তার অবৈধ সম্পদ মর্মে প্রতীয়মান হওয়ায় তার বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর ৪(২) ও ৪(৩) ধারা এবং দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ এর ২৭(১) ধারা তৎসহ ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় মামলা রুজুর সুপারিশ করে প্রতিবেদন দাখিল করেন অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা।
গ্রাহকের কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ মাথায় নিয়ে পুলিশের এ কর্মকর্তা দেশ থেকে নেপালে পালানোর সময় গত বছরের ৩ সেপ্টেম্বর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহারের চ্যাংড়াবান্দায় সেদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) হাতে ধরা পড়েন। এরপর তাকে দেশে ফেরত চেয়ে ভারতের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দফায় দফায় চিঠি দেয় বাংলাদেশ পুলিশ সদরদপ্তর।
জানা যায়, অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশ ও বিদেশি মুদ্রা বহন করাসহ একাধিক অভিযোগে সোহেল রানার বিরুদ্ধে ভারতে মামলা হয়। তাকে ফেরানোর জন্য পুলিশ সদরদপ্তরের এনসিবি শাখা ভারতের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরোকে (এনসিবি) গত এক বছরে তিন দফা চিঠি দিলেও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। এরপর তাকে দেশে ফেরানোর বিষয়টি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হাতে ন্যস্ত করে পুলিশ সদরদপ্তর। ধারণা করা হচ্ছে, এখন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে কূটনৈতিক পন্থায় সোহেল রানাকে ফেরত আনার প্রক্রিয়া শুরু করতে পারে সরকার।
সোহেল রানা গ্রাহকের কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎকারী বহুল আলোচিত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ই-অরেঞ্জের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে প্রতারণার একাধিক মামলার আসামি। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) বনানী থানার বরখাস্ত এ কর্মকর্তার বোন সোনিয়া মেহজাবিন ও ভগ্নিপতি মাসুকুর রহমান ই-অরেঞ্জ প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করছিলেন। সোহেল রানার বোন প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী সোনিয়া ও ভগ্নিপতি মাসুকুর বর্তমানে কারাগারে।
জানা যায়, ঢাকায় সোহেল রানার চারটি ফ্ল্যাট, ৯ কোটি টাকা মূল্যের একটি বাণিজ্যিক ভবন এবং একাধিক প্লট রয়েছে। এছাড়া খাগড়াছড়িতে রিসোর্টের জন্য জমি কিনেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
অগ্রিম অর্থ পরিশোধের পরও মাসের পর মাস পণ্য না পাওয়ায় গত বছরের ১৬ আগস্ট ই-অরেঞ্জের বিরুদ্ধে মামলা করেন প্রতারণার শিকার গ্রাহক মো. তাহেরুল ইসলাম। ওই সময় তার সঙ্গে প্রতারণার শিকার আরও ৩৭ জন উপস্থিত ছিলেন। মামলায় গ্রাহকের ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়। ওই মামলার আসামিরা হলেন ই-অরেঞ্জের মালিক সোনিয়া মেহজাবিন, তার স্বামী মাসুকুর রহমান, আমানউল্ল্যাহ, বীথি আক্তার, কাউসার আহমেদ ও পুলিশের বনানী থানার বরখাস্ত পরিদর্শক সোহেল রানা। মামলার এজাহারে উল্লিখিত আসামিদের প্রত্যেককেই ই-অরেঞ্জের মালিক বলে দাবি করা হয়।
মামলায় উল্লেখ করা হয়, করোনাকালে ভুক্তভোগীদের কষ্টার্জিত অর্থের নিশ্চয়তা না দিয়ে ই-অরেঞ্জ তাদের মালিকানা পরিবর্তনের নামে ধোঁয়াশা সৃষ্টি করছে। নতুন মালিক ও পুরোনো মালিকের কোনো তথ্য ভুক্তভোগীদের সামনে প্রকাশ করা হচ্ছে না। এছাড়া আসামিরা সব ধরনের অফিসিয়াল কার্যক্রম বন্ধ করে গাঢাকা দিয়েছেন বলেও মামলায় উল্লেখ করা হয়।
ই-অরেঞ্জ শপের বিরুদ্ধে অর্ডার নিয়ে পণ্য ডেলিভারি না দেওয়ার অভিযোগে গত বছরের ১৬ আগস্ট রাজধানীর গুলশানে বিক্ষোভ করেন ভুক্তভোগীরা। পাওনা অর্থ ও পণ্যের দাবিতে বাংলাদেশ জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক ও সংসদ সদস্য মাশরাফি বিন মর্তুজার মিরপুর-১২ নম্বর এলাকার বাসার সামনে বিক্ষোভ করেন তারা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ পুলিশের এনসিবি শাখা থেকে গত বছরের ৫ সেপ্টেম্বর প্রথম এবং ৭ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় দফায় অতিরিক্ত তথ্য সংযুক্ত করে চিঠি পাঠানো হয় দিল্লির এনসিবিতে। দুই দফার চিঠির উত্তর না পাওয়ায় একই বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর তৃতীয় দফায় চিঠি পাঠায় পুলিশ সদর দপ্তর। তবে এ চিঠি পাঠানোর পরেও দিল্লির পক্ষ থেকে সাড়া মেলেনি। এরপরই পুলিশ সদরদপ্তর বিষয়টি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠায়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সদরদপ্তরের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরোর (এনসিবি) সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) এহসান সাত্তার জাগো নিউজকে বলেন, ভারতে আটক সোহেল রানাকে ফেরত চেয়ে দিল্লি এনসিবিকে তিন দফায় চিঠি পাঠানো হয়। তবে ভারতের সাড়া না পাওয়ায় বিষয়টি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়টি দেখবে।
ই-অরেঞ্জের ১১০০ কোটি টাকা আত্মসাতের বিষয়টি অনুসন্ধান করছে সিআইডি
ই-অরেঞ্জ শপের বিরুদ্ধে ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা প্রতারণামূলকভাবে আত্মসাতের অভিযোগে ভুক্তভোগীদের করা মামলার অভিযোগ অনুসন্ধানে নেমেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। প্রতিষ্ঠানটি গ্রাহকের আত্মসাৎ করা বিপুল পরিমাণ অর্থ কী করেছে, তা জানতে এরই মধ্যে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। সিআইডি বলছে, ই-অরেঞ্জের বিরুদ্ধে প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় গুলশান থানায় যে মামলা করা হয়েছে তার অনুসন্ধান চলছে। এ মামলার আসামিসহ বেশ কয়েকজনের তথ্য ও ব্যাংক হিসাব খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
সিআইডি সূত্রে জানা গেছে, ই-অরেঞ্জের বিরুদ্ধে প্রতারণার মামলা হলেও সিআইডি তাদের মানি লন্ডারিংয়ের বিষয়টিও অনুসন্ধান করছে। পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটি কেন বা কী কারণে হঠাৎ (২০২১ সালের ১ জুলাই) মালিকানা পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিলো ওই বিষয়েও অনুসন্ধান করা হচ্ছে।
ই-অরেঞ্জের বিরুদ্ধে সিআইডির ২৩২ কোটি টাকার মানি লন্ডারিং মামলা
গত বছরের ৪ অক্টোবর ই-অরেঞ্জের বিরুদ্ধে ২৩২ কোটি ৪৩ লাখ টাকার মানি লন্ডারিং মামলা করে সিআইডি। মামলার নথিতে বলা হয়, অভিযুক্ত কর্মকর্তারা ই-কমার্সের ছদ্মবেশে গ্রাহকদের কাছ থেকে পেমেন্টের নামে বিপুল অঙ্কের অর্থ আত্মসাৎ করতেন।
ই-অরেঞ্জের অর্থপাচার বিষয়ে দুদককে নোটিশ করার নির্দেশ
চলতি বছরের ৬ এপ্রিল ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ই-অরেঞ্জের কাছে আটকে থাকা গ্রাহকের টাকা বিদেশে পাচারের বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কোনো বক্তব্য আছে কি না, সেটি জানতে সংস্থাটির প্রতি নোটিশ করার জন্য প্রতারণার শিকার গ্রাহকদের পক্ষে রিটকারী আইনজীবীকে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
৭৭ কোটি টাকা ফেরত চেয়ে ই-অরেঞ্জের ৫০০ গ্রাহকের রিট
চলতি বছরের ৩ এপ্রিল ই-অরেঞ্জের কাছে গেটওয়েতে আটকে থাকা ৭৭ কোটি টাকা ফেরত দেওয়ার নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন প্রতারণার শিকার পাঁচ শতাধিক গ্রাহক। প্রতিষ্ঠানটির অর্থের উৎস অনুসন্ধানসহ রিটে গ্রাহকদের অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় সুষ্ঠু তদন্তের নির্দেশনা চাওয়া হয়।
এর আগে হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় পাঁচ শতাধিক গ্রাহকের পক্ষে ব্যারিস্টার এম. আব্দুল কাইয়ুম এ রিট আবেদন করেন। রিটে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি), বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ), ই-অরেঞ্জের সোহেল রানা, সোনিয়া মেহজাবিন, বীথি আক্তার এবং বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্টদের বিবাদী করা হয়।